অনলাইন ডেস্ক:
কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরের ‘লক্ষীপুর দ্বি-মুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের’ ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি নুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের নানান অভিযোগ উঠেছে। ক্ষমতাসীন সরকারি দলে কোন পদ-পদবী না থাকলেও দলের প্রভাব খাটিয়ে দিনের পর দিন তিনি অনিয়ম করে চলেছেন। তার বিরুদ্ধে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে টাকার বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগ, এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ফরম পূরণে অতিরিক্ত অর্থ আদায়, কোন কারণ ছাড়া শিক্ষকদের বেতন কাটাসহ নানান অভিযোগ উঠেছে।
স্থানীয়রা বলছে, একসময় বিএনপি-জামায়াতের সমর্থক থাকলেও বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এলে তিনি দলপাল্টে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। তবে নেই কোন পদপদবিতে। দুইবার ইউপি নির্বাচনে প্রার্থী হলেও বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছেন। তার ইন্ধনে লক্ষীপুর মাতুয়ারকান্দা থেকে লক্ষীপুর বাজার সড়কের নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়।
জানা যায়, কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলার লক্ষীপুর গ্রামে ১৯৪৭ সালে ‘লক্ষীপুর দ্বি-মুখী উচ্চ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে অনেকে শিক্ষাগ্রহণ করেছেন। যারা সরকারি-বেসরকারি বড় বড় পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। নুরুল ইসলাম সুনামধন্য এই প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির পদে দায়িত্ব পাওয়ার পর নানান অনিয়ম শুরু হয়। সেখানে কর্মরত একাধিক শিক্ষক ও কর্মচারিরা বিভিন্ন সময় তার মাধ্যমে নানান ভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন। কিন্তু এসব বিষয়ে প্রকাশ্যে কেউ কোন কথা বলতে সাহস পান না। বিশেষ করে নুরুল ইসলাম সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে অযোগ্যদের টাকার বিনিময়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সাইমা আক্তার। তার বাবা দৌলত মিয়া কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। কষ্টের সংসারে কোনভাবে মেয়েকে পড়াশোনা করাচ্ছেন তিনি। স্কুল থেকে মেয়ের উপবৃত্তি পেতে বেশ কয়েকবার ধর্না দেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির সভাপতি নুরুল ইসলামের কাছে। কিন্তু ১৫’শ টাকা ঘুষ না দেওয়া উপবৃত্তির তালিকায় নাম দেওয়া হয়নি সাইমা’র।
দৌলত মিয়া বলেন, ‘আমি একজন গরীব মানুষ। খুব কষ্ট করে মেয়েটারে স্কুলে পড়াইতেছি। শুনেছি স্কুল থেকে ছাত্রছাত্রীরা নাকি উপবৃত্তি টাকা পায়। সেজন্যই স্কুলের সভাপতি নুরুল ইসলামের কাছে কয়েকদিন গিয়েছি। কয়েকবার তিনি আমাকে ঘুরিয়েছেন। কয়েকদিন আগে তার কাছে গিয়েছিলাম। এসময় তিনি বললেন আমাকে (নুরুল) ১৫শ টাকা দিতে পারবা? যদি দিতে পারো তাহলে তোমার মেয়ে উপবৃত্তির টাকা পাবে। উত্তরে আমি বলি এত টাকা আমার কাছে নেই; থাক আমার উপবৃত্তি লাগবে না।’
নাম প্রকাশ না শর্তে এই স্কুলের আরেক শিক্ষার্থীর বাবার অভিযোগ উপবৃত্তির তালিকায় তার সন্তানের নাম ছিল। সবাই উপবৃত্তির টাকা মোবাইলে পাচ্ছিল; কিন্তু তার সন্তানের টাকা আসেনি। বিষয়টি নিয়ে তিনি স্কুলে গিয়ে সভাপতি সঙ্গে কথা বলেন। এসময় সভাপতি তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন এবং স্কুল থেকে বের করে দেন। এসময় সভাপতি বলেন, ‘যারা টাকা দিয়েছে তাদের নামই তালিকায় এসেছে। তুমি টাকা দেও নিই, তাহলে টাকা আসবে কিভাবে?’
লক্ষীপুরের বাসিন্দা আবুল কালাম। তিনি বলেন, ‘স্কুলের কাছের বাজারে বসে প্রতিদিনই চা খাই। সেখানে স্কুলের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা সভাপতি নুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে নানান অভিযোগের কথা বলে। বিশেষ করে উপবৃত্তির তালিকায় নাম উঠানোর কথা বলে বাড়তি টাকা চাওয়ার কথা বেশি শোনা যায়। এছাড়া এসএসসির ফরমপূরণে বাড়তি টাকা নেওয়ার অভিযোগ করেছেন অনেকে। তবে তার বিরুদ্ধে সরাসরি প্রতিবাদ করার সাহস কারও নেই।’
কালাম বলেন, ‘উনি (নুরুল) শুধু স্কুল নয় গ্রামের মধ্যেও বিভিন্ন ইস্যুতে মানুষের মধ্যে ঝগড়া ফ্যাঁসাদা সৃষ্টি করেন। এলাকার গ্রাম্য শালিশে সুষ্ঠু বিচার না করে কীভাবে সমস্যাটা লাগিয়ে রাখা যায়, সেটা বেশি করেন। আবার যে দিক থেকে বেশি টাকা পান, সেদিক টেনে বিচার করেন। নুরুল ইসলাম নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করেন। কিন্তু গ্রামের মুরব্বিরা বলেন, তিনি কখনও মুক্তিযুদ্ধ করেননি বা মুক্তিযুদ্ধে সহযোগীতাও করেননি।’
১নং গোবরিয়া আব্দুল্লাহপুর ইউনিয়নের বীর মুক্তিযোদ্ধা শামসু উদ্দিন বলেন, ‘আমরা যখন দেশ স্বাধীনের জন্য বঙ্গবন্ধুর ডাকে প্রথম ভারতে গিয়ে যুদ্ধের ট্রেনিংয়ে গিয়েছিলাম, তখন তো নুরুল ইসলামকে দেখেনি। উনি কোথায় ট্রেনিং ও যুদ্ধ করেছেন সেটাও আমরা জানি না। হঠাৎই উনি নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করেছেন। এলাকার সবাই জানেন উনি একজন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। আমরা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ থেকে সরকারের কাছে আবেদন করেছি। তাকে যেন মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তাকে যেন অন্তঃর্ভূক্ত না করা হয়।’
গোবরিয়া আব্দুল্লাহপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু বক্কর প্রতিবেদককে বলেন, ‘উনি একসময় বিএনপি ঘরোয়ার মানুষ ছিলেন। পরবর্তীতে সরকারি দলের সমর্থক হিসেবে যুক্ত হন। তবে পদ-পদবীতে নেয় তিনি। সরকারি দলের সমর্থক হওয়ায় এলাকায় প্রভাব দেখান। তার অনিয়ম সম্পর্কে লোকমুখে অনেক কথার প্রচলন আছে।’
ইউনিয়ন ছাত্রলীগ সভাপতি মো. কামাল হোসেন বলেন, ‘নুরুল ইসলাম একজন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। আর তিনি ইউনিয়ন বা উপজেলা আওয়ামী লীগের কোন পদে নেই। দলের নাম ভাঙ্গিয়ে এলাকাতে নিজের অবস্থা তৈরি করার জন্য নানার অপকর্ম করছেন। স্কুলের পাশ দিয়ে লক্ষীপুর মাতুয়ারকান্দা থেকে লক্ষীপুর বাজার পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণের জন্য প্রকল্প আসে। রাস্তায় মাটি ফেলা শুরু হলে নুরুল ইসলাম বিভিন্ন কৌশলে গ্রামের দুইপাড়ার মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি করে। এতে রাস্তার কাজ বন্ধ হয়ে যায়। কারণ কিন্তু উনি (নুরুল) চান না বিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে দু’পাড়ার মধ্যে সংযোগ সড়কটি হোক।’
কামাল হোসেন আরও বলেন, ‘এই রাস্তা নির্মাণকে কেন্দ্র করে গ্রামবাসীর মধ্য সংর্ঘষে চার মাসে দুইটি খুন হয়েছে। পরিবারগুলো এখন মানবেতর জীবন যাপন করছে। বিভিন্ন সময় শুনছি নুরুল ইসলাম বলেছেন, ‘দুটি মার্ডার করিয়েছি, আরও হবে। … আমাকে তো চেনো না।’
স্কুলের একাধিক শিক্ষক নাম প্রকাশ না শর্তে প্রতিবেদককে জানান, সম্প্রতি স্কুলের আর্থিক নিরিক্ষা করতে শিক্ষা অফিস থেকে ঊদ্ধর্তন কর্মকর্তারা আসেন।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.